জলের সঙ্গে মানুষের বন্ধন কেমন, দেখা যায় আবহমান বাংলার পথ-প্রান্তর ঘুরলেই। কারু তিতাস জলরঙে মানুষের সঙ্গে তৈরি করেছেন বন্ধন। হ্যাঁ, তিতাসের ছবি নদীর সঙ্গে মানুষের বন্ধনের ঘোষণাই দেয়। প্রাচ্যকলা অথবা একাডেমিক চিত্রকলাচর্চায় প্রায়ই আমরা দেখতে পাই নদী-নৌকা, মানুষ প্রকৃতি, ফুল, পাখির দৃশ্যকল্প। তো, তিতাসের ছবিতেও আবহমান বাংলার সেই রূপমাধুরী স্পষ্ট।
‘জলযাত্রা’ নামে কারু তিতাসের প্রদর্শনীতে মোট কাজের সংখ্যা ৪৫টি। ছবিগুলোকে বিশ্লেষণ করা যায় মূলত তিন ভাগে। গ্রামবাংলার নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা, সবুজ পাহাড়ের দিকে ধাবিত হওয়া যাত্রীবাহী নৌকা, দূর পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘরবসতি—প্রথম ভাগে ছবিগুলো এমন। ছবিতে মানুষের সঙ্গে নদীর, নদীর সঙ্গে প্রকৃতির বন্ধন বেশ জোরালোভাবে প্রতিভাত হয়। দ্বিতীয় ভাগে আঁকার বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ফুলের মাঝখানে নানান বর্ণের স্ফুরণ। বর্ণে বর্ণে নানান ফুল মনকে যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি দেয়ালে শোভা পাওয়া ফুলের সমাবেশ পুরো কক্ষকেই অবিষ্ট করে রঙে।
তৃতীয়ত, স্তরের ছবিতে বিমূর্ত আধা বিমূর্ত ক্যানভাসে ভঙ্গুর বা ঋজু আকৃতির উপস্থিতি প্রতীকবাদী আচরণের ঘোষণা দেয়। অনেক সময় নিয়ে তাঁর কাজে প্রতীকবাদিতার আশ্রয় নিয়েছেন তিতাস। তাঁর বিমূর্ত ঘরানার কাজগুলো বাছাই করা নির্দিষ্ট রঙের সাহায্যে গড়া। রং, আকৃতি, বিন্দু, বিসর্গ, ফোড়নের সাহায্যে প্রতীক তৈরি করা ছবির গড়নশৈলী তিনি নির্মাণ করেন নিপুণ হাতে। আলোচ্য প্রদর্শনীতে তিতাসের ছবির তিনটি ভাগ বা মাত্রা বৈচিত্র্য যেমন সৃষ্টি করে, একইভাবে দর্শককে স্বস্তিও দেয়। বলা ভালো যে প্রদর্শনীর কাজগুলো প্রকৃতি বা মানুষের সরাসরি অনুকৃতি নয়, অনুকরণের পরিবর্তে বিষয়কে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে এখানে।
ছবিগুলোর মাধ্যম জলরং ও অ্যাক্রেলিক। অ্যাক্রেলিক মাধ্যমের কাজগুলোতে কোথাও কোথাও জলের ধোয়া রয়েছে। জলরঙে আঁকা ছবিতে জলের ধোয়া পদ্ধতির সঙ্গে বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনার অভ্যাস দৃশ্যমান। এ উপমহাদেশে জলরং ব্যবহার করে ছবি আঁকার প্রচলন বহু পুরোনো। মোগল শিল্পরীতিতে মিনিয়েচার আঁকার মাধ্যম ছিল জলরং। তবে জলরঙে তিতাসের কাজ করার পদ্ধতি খানিকটা ভিন্ন। জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতি অনুসরণ করেন তিনি, কিন্তু তাতে আবার ব্যবহার করেন কিছু বিন্দু ও বুনট, যা তাঁর নিজস্ব।
এই শিল্পীর একটি ছবিতে দেখা যায়, দুই নৌকা এগোচ্ছে পাহাড়ের দিকে। নৌকার গলুই বাইছে যে ব্যাক্তি তঁার ভঙ্গি ও গতিতে রয়েছে ক্ষিপ্রতা। দুটি নৌকার গতিই প্রায় কাছাকাছি। দূরে সবুজ রঙে ছেয়ে আছে পাহাড়। নৌকার গন্তব্য ওই পাহাড়ের দিকে। এভাবে অধিকাংশ চিেত্রই একটি সুনির্দিষ্ট দিকের নিশানা আছে। আর তিতাসের ছবির একটি বিশেষত্ব বুঝি এটিই।
তাঁর সব ছবির শিরোনামেই রয়েছে ‘জলযাত্রা’। বাস্তবধর্মী চিত্ররচনার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ছবির নির্দিষ্ট একটি অংশ বেছে নিয়ে সেখানে জ্যামিতিক আকৃতি হাজির করেছেন তিতাস। আবার কখনোবা জ্যামিতিক আকৃতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন বাস্তবধর্মী অবয়ব।
একক প্রদর্শনী হিসেবে এটি কারু তিতাসের দ্বিতীয়। দ্বিতীয় এককে এসে তিনি যে কাজ করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তবে স্থাপন করার ক্ষেত্রে ছবিগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে লাগালে প্রতিটি ছবিই আরও সুন্দরভাবে দেখা যেত। গত ২৯ জুলাই শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ১২ আগস্ট পর্যন্ত।